রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী | Rabindranath Tagore Biography in Bengali
সূচনা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে প্রবেশের পূর্বে একজন ছাত্র বা ছাত্রী প্রথমেই যাকে চেনে , যার হাত ধরে হাঁটতে শেখে ,যিনি প্রায় গুরুদেবের মতোই সেই সাহিত্যের ছাত্রটি চলার পথের পূর্বে আলোকবর্তিকা নিয়ে চলেন ,যে মানুষটিকে সমস্ত বাঙালি জাতি প্রায় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সমকক্ষ মনে করেন তিনি হলেন আমাদের সবার আদর্শ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখা যুগ যুগ ধরে বাঙলা তথা পৃথিবীর সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে অনন্তের সাথে মিলনের অনুপ্রেরণা যোগায়। তার গান আমাদের আত্মার শান্তি,আমাদের প্রেরণা ,আমাদের দুঃখের দিনের শক্তি। ..
কবির জন্ম ও বাল্যকাল
রবিঠাকুর হলেন পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানবের তীর্থভূমি .ইংরেজি ৭ই মে ,১৮৬১ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কলকাতায় তার জন্ম হয়।
তার জন্মদিন বাংলা পঁচিশে বৈশাখ আজো বাঙালির ঘরে ঘরে পালিত হয়। তার পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী।
মাত্র ৮ বছর বয়সে ভানুসিংহ ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উনিশ শতকের বাঙলা সঙ্গস্কৃতির ও ধর্মবিশ্বাসের জগতে একজন পুরোধা ব্যাক্তিত্ব। আসাম,ত্রিপুরা,ও বাংলাদেশে কবির বংশের জমিদারি বিস্তরিত ছিলো। তার পিতা ছিলেন তৎকালীন যুগের আলোকিত এক ব্যাক্তিত্ব। তার পিতার ধর্মবিশ্বাস ই কবির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি পরিবারের অষ্টম সন্তান। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে তার মাতা সারদাদেবীর মৃত্যু হয়।
রবিঠাকুরের শিশুশিক্ষা
শিশুকাল থেকেই অন্যানো সন্তানদের মতোই রবীন্দ্রনাথ অভিজ্ঞ পরিচারকের দ্বারা লালিত হন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ও কয়েকজন কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে তার প্রাথমিক বিদ্যালাভ হয়। তাদের কাছেই তার সাহিত্যের পাঠের হাতেখড়ি। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। প্রকৃতি তার ছেলেবেলার সাথী। পরবর্তীকালে তার কবিতায় এই প্রকৃতি চেতনার কথা বারে বারে উঠে আসে। পারিবারিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষলাভ করলেও স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম ও আবহাওয়া তার মনঃপুত না হওয়ায় গৃহেই পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয় …… .বাড়িতেই বিশ্ববিদ্যার সকলদুয়ার তার কাছে উন্মুক্ত হয়ে গ্যালো । শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি,নরমাল স্কুল ,বেঙ্গল একাডেমি ,সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন । ১১বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে এক সুন্দর প্রভাতে পারিবারিক পুরোহিতের হাত ধরে তার ব্রাহ্মণত্বে দিখয়ালাভ হয়। এরপর তিনি কয়েকমাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে প্রথম গৃহের বাইরে পা রাখেন। প্ৰথমে তারা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। এরপর মহর্ষির সাথে তার হিমালয় যাত্রা। ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায় বসে রবীন্দ্রনাথের পিতার কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণ ,ইংরেজি ,জ্যোতির্বিজ্ঞান ,সাধারণ বিজ্ঞান ,ইতিহাসের পাঠ নিতে শুরু করেন। কিশোর বয়স থেকে তার কাব্যচর্চার সূত্রপাত। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের বিদেশভ্রমণ ও ফিরে আসা
১৮৭৮ সালে তাকে ব্যারিস্টারি শিক্ষার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। সেখানেই তার পরিচয় ঘটে আনা লুসি স্ট্রং নাম এক কিশোরীর। কিন্তু পশ্চিমি সভ্যতার বস্তুবাদী অভিব্যক্তি কবির মনকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে নি। যদিও সেখানে সল্পকাল বাসস্থানের পর সেখানকার সাহিত্য সংস্কৃতির খবর ও প্রাশ্চ্যাতো সঙ্গীতের সুরমূর্ছনা নিয়ে কবি কোলকাতায় ফিরে আসেন। সাথে করে নিয়ে আসেন প্রথম বিলেত বাসের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি। বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন গান পাগল। মূলত তারই অনুপ্রেরণায় কবির প্রাণে এলো গানের জোয়ার। রচনা করলেন অনবদ্য গীতিনাট্য ,বাল্মীকি প্রতিভা।
সাহিত্য রচনা
১৮৭৮সালে তার প্রথম বই কবিকাহিনী প্রকাশিত হয়। তারপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যাসংগীত ,প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান করি কোমল , মানসী,সোনার তরী কাব্যসমূহ। তারপর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক কাব্যগ্রন্থ। যেমন চিত্র, চৈতালি, কণিকা,কল্পনা, কথা ও কাহিনী নৈবেদ্য ,খেয়া ,গীতাঞ্জলি ,গীতালি ইত্যাদি। শুধু কাব্যে নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রায় সব্যসাচীর মতোই এক ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলা সাহিত্যের বিস্তারিত .অঙ্গনে সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন প্রায় এক শতাব্দী কাল। নাটক,প্রবন্ধ ,গল্প,উপন্যাস ,রসরচনা সমালোচনা রূপক ,নাটক ,শিশুসাহিত্য ,বিজ্ঞান সমাজতত্ব ,শিক্ষাতথ্য ,সংগীত,স্কুলপাঠায়া,ভ্রমণকাহিনী। ,সাহিত্য ও শিল্পের সর্বক্ষেত্রেই তার অবাধ যাতায়াত।,বাংলা ও বাঙালির চিরকালের পাথেয় হয়ে থাকবে। শেষজীবনে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর অনুপ্রেরনাএ তিনি প্রায় দু হাজারের মতো ছবি এঁকেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলি চিরায়ত চিত্রকলা বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের কাছে সীকৃতি পেয়েছে।
তিনি ছিলেন একজন কবি। মাত্র ৮ বছর বয়সে তার কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে আজো বাঙালির মন তার দুঃখচেতনা ,তার মৃত্যূ চেতনা ,তার প্রকৃতিচেতনা রবিঠাকুরের গানে শান্তি খুঁজে পায়। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হলো বৌ ঠাকুরানীর হাট ,১৮৮৩,রাজর্ষি ১৮৮৭, চোখের বালি ১৯০৩, নৌকাডুবি১৯০৬, প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৯০৮, গোড়া ১৯১০, ঘরে বাইরে ১৯১৬, চতুরঙ্গ ১৯১৬ ,যোগাযোগ ১৯২৯, শেষের কবিতা ১৯২৯ ,দুই বোন ১৯৩৩, মালঞ্চ১৯৩৪, চার অধ্যায় ১৯৩৪। তার প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা হলো বৌ ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষি। চোখের বালি উপন্যাসে আমরা খুঁজে পাই তার সমসাময়িক কালের বিধবা নারীগণের নানা সমস্যা। তার উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে ,ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়
১৯১২ সালে লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটি থেকে জনৈক ইংরেজের অনুপ্রেরণায় তার গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। আইরিশ কবি ডাব্লিউ বি ইয়েটস গীতাঞ্জলির ভূমিকা লেখেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতীচ্যের বিদগ্ধ সমাজে বিপুল সারা পরে যায়। ১৯১৩ সালে রবি কবি তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল লাভ করেন।
নাইট উপাধি ত্যাগ
সাল ১৯৯৫। তখন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন। ব্রিটিশরাজ কবিগুরুকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র ভারতীয়দের একটি সমাবেশের ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে গুলি চালায়। নিহত হয় প্রায় শতাধিক মানুষ। তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি পরিত্যাগ করেন
বিশ্বভ্রমণ
তার নোবল পুরস্কার প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ,আমেরিকা,চীন,জাপান ,রাশিয়া ,মালয় ,পারস্য ,প্রভৃতি দেশ ভ্ৰমণ করেন এবং এইসব দেশে বহু বক্ত্রিতা ও রচনা পথ করেন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাত্তেই তার রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের বিদগ্ধ মানুষ ,কবি লেখক বুদ্ধিজীবীরা তাকে মনীষী হিসাবে শ্রদ্ধা করেন মোট বারো বার তিনি বিশ্ব ভ্রমনে বেরিয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটির বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। তার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাঃ গুলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। ১৮৮১ সালে ইউরোপ প্রবাসীর পত্র
,১৮৯১সালে ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরি ,১৯১৯সালে জাপান যাত্রী,১৯২৯ সালে জাভা যাত্রীর ডায়েরি ,১৯৩৯ সালে রাসিয়ার চিঠি ,১৯৩৬ সালে পারস্যে ১৯৩১ সালে পথের সঞ্চয় ইত্যাদি গদ্য ও প্রবন্ধ সংগ্রহে তার বিদেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা
১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন। এটি আজো বাংলা তথা ভারতের শিশুশিক্ষা ,
উচ্চশিক্ষার জগতে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান দেশ বিদেশের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্ব এখানে শিক্ষকতা করতেন। আজ তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রূপে খ্যাত। তার রচিত সংগীত জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ,ভারতের জাতীয় সংগীত রূপে খ্যাত। এ বং তার আমার সোনার বাংলা ,আমি তোমায় ভালোবাসি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত ও সমাদৃত।
রবীন্দ্রনাথের নাট্যসাহিত্য
তিনি একাধারে ছিলেন নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা। মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হটাৎ নবাব নাটকে ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অলিকবাবু নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮১ সালে তার প্রথম গীতিনাট্য বাল্মিকীপ্রতিভা মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পরিচয় তার বেশ কিছু প্রবন্ধ সাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থর মধ্যে খুঁজে পাওয়াযায়। ১৯১৯ সালে তার নাইটহুড ত্যাগের প্রত্যাখ্যান পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে তিনি লিখেছিলেন ,আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি। তার চিত্ত যেথা ভয়শূন্য ওএকলা চলোরে রাজনৈতিক চেতনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর।
মৃত্যুশয্যায় কবি
জীবনের শেষ চার বছর ছিল তার ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। ১৯৩৭সালে একবার অচিত্যন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কা জনক অবস্থা হয়ে ছিল কবির। এই সময় পর্বে তার বেশিরভাগ কবিতা ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করেসৃজিত কিছু অবিস্বরণও পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্ত কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে ৭ই আগস্ট শ্রাবন মাসে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। ২৫শে বৈশাখের সূর্য ২২সে শ্রাবনের সন্ধ্যায় অস্ত গেলো।
তার মহাপ্রয়াণে বাঙালির তথা বিশ্ববাসীর জীবন থেকে একটা মহান সূর্য অস্তমিত হলো..। আমরা আজ তাকে শ্রদ্ধার ও প্রেমের সঙ্গে স্মরণ করি।