ক্ষুদিরাম বোস জীবনী | Khudiram Bose Biography in Bengali
সূচনা
ঊনবিংশ শতকের শেষ অধ্যায় বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য সময় । বাংলাদেশ তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। বিদেশী ইংরেজ সরকার চাইছে বাংলাকে ভেঙে দু ভাগ করে তার শাসনক্ষমতা আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে। আর অন্যদিকে বাংলার বিপ্লবীরা চাইছেন তরুণ কিশোর যুবসম্প্রদায়কে স্বাধীনতা অর্জনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। মেদিনীপুর জেলা তখন বারুদের স্তূপ। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে নির্ভিক বলিষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী বীর যুবকদের নির্মাণ করার প্ৰচেষ্টা। মা ও বোনেরাও এ কাজে সামিল। ঠিক এ সময়েই মেদিনীপুরের মোহবনী গ্রামে জন্ম হলো অগ্নিযুগের বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর .ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম শহীদ।
জন্ম
১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর মেদিনীপুর গ্রামে ক্ষুদিরামের জন্ম। পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু।ও মাতা লক্ষীপ্রিয়া দেবী। তার জন্মের পূর্বে তার দুই ভাই মারা যায় .। তাই ক্ষুদিরামের দিদি অপরূপা দেবী তিন মুঠো খুব দিয়ে তার এই ভাই টাকে কিনে নেয় ।ক্ষুদ দিয়ে কেনা হয়েছিল বলে তার নাম হয়েছিল ক্ষুদিরাম। খুব ছোটবেলাতেই তিনি তার মা বাবাকে হারিয়ে ছিলেন। তারপর থেকে তার দিদির কাছেই তিনি মানুষ। তার স্নেহভালবাসতে ছোট্ট খুদি ক্রমশ বড়ো হয়ে ওঠেন ।তার জামাইবাবু তখন তমলুকের দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার । অপরূপা দেবীর স্বামী অমৃতলাল বাবু মাঝে মাঝেই স্থানান্তর হতো। এই বদলির চাকরি তাকে কোনো জায়গায় স্থির থাকতে দিতো না। ফলে ক্ষুদিরামও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারতেন।
শিক্ষাজীবন
অমৃতলাল বাবু যখন মেদিনীপুরে বদলি হয়েছেন তখন তাকে ভর্তি করা হলো মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলেই একজন শিক্ষক
ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ।তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন খুব জোরালো হয়ে উঠেছিলো। তিনি চাই ছিলেন অল্পবয়সী
ছেলেদের নিয়ে একটি দোল গড়ে তুলতে। এটির নাম দিলেন অনশীলন সমিতি। তার এই দলে এসে যোগ দিলেন ক্ষুদিরাম। তারপর থেকেই তার জীবনেও ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন দেখা দিলো। ক্ষুদিরাম হয়ে উঠলেন এক অন্য মানুষ। লঠিখেলা শিখলেন ,ব্যায়ামের দ্বারা শরীরকে আরও মজবুত করে তুললেন তিনি। তার সংকল্প ছিল গ্রামের সকল মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তুললেন।
কর্মজীবন
ক্ষুদিরামের প্রাণ ছিল দরদী। আর তার মধ্যে ছিল মানুষ ও দেশের প্রতি গভর ভালোবাসা। কারো অসুখে তার প্রাণ কেঁদে উঠতো। জনগণের সেবা করাই ছিল তার ব্রত। আবার কখনো কাউকে কাউকে উপবাসী দেখলে তিনি সেখানে দৌড়ে যেতেন। দুটি অন্যের ব্যবস্থার করতে। প্রকৃতির নানা দুর্যোগেও মানুষের সাহায্যের জন্য তিনি বাড়ি বাড়ি অর্থ সংগ্রহ করতেন।
স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষুদিরামের ভূমিকা
অগ্নিযুগের বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় স্বদেশীর আন্দোলনের যুগে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শোষণ ও পীড়নে কাতর বাংলা তথা ভারত কাঁদছে। সেইসময় দেশের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বিদেশির জিনিস বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিলিতি কাপড় ,বিলিতি নূন ,লুঠ করার কাজে নেতৃবৃন্দ প্রচার শুরু করেন। চারিদিকে ব্রিটিশ জাতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও আন্দোলনের শুরু হলো। এই সময়ে মেদিনীপুরের একটি শিল্পমেলা বসে। এই মেলা প্রাঙ্গনে’সোনার বাংলা’ নামে বিপ্লবী পুস্তিকা বিলি করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম প্রথম রাজনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিনি তখন হটাৎ সেই সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তার বুকে এক প্রচ্ণ্ড আঘাত করে পালিয়ে যান। কেউ তাকে ধরতে পারলো না। তারপর তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ।একদিন তিনি ধরা পড়লেন ।পুলিশ ক্ষুদিরামের উপর ভীষণ অত্যাচার করলেন। তখন সরকার ক্ষুদিরামকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। কিন্তু তিনি একটিও কথা প্রকাশ করলেন না। মুখ বুজে সবাই সহ্য করলেন। তখন সরকার ক্ষুদিরামকে ছেড়ে দিতে বাঁধ হলো। এরপর থেকে তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে ভপরতে লাগলো। বাংলার বিপ্লবীদের মুখে মুখে ক্ষুদিরামের নাম।
কিংসফোর্ডকে হত্যা
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে ইংরেজ শাসকগণ ভারতীয় দের উপর প্রচন্ড অত্যাচার চালাতো। বিশেষ করে ভারতের কৃষকসমাজ ইংরেজ শাসকগণ জোতদার ,ও সুদখোর মহাজনদের হাতে ভীষণভাবে শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল। তখন মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড সাহেব। তার বিরুদ্ধে বিপ্লবী দের মধ্যে প্রচন্ড খুব ছিল। কারণ ছিল ভারতীয়দের উপর কিংসফোর্ডের মাত্রাহীন অত্যাচার। এরই মধ্যে মাত্র ১২ বছর বয়সে বালক সুশীল সেনকে বিনা অপরাধে প্রহার করায় বিপ্লবীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জলে উঠলো .।
তারা এই অত্যাচারকে মেনে নিতে পারলো না। এক গোপন সভায় স্থির হলো কিংসফোর্ডকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে ।আর তার ভার দেয়া হলো ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীকে। হাসিমুখেওরা সব নির্দেশ মেনে নিলেন। সেটা ১৯০৮ সালের কথা। চেমসফোর্ডকে বদলি করা হলো বিহারের মোজাফরপুর জেলায়। বিপ্লবীদের চেষ্টা সে যাত্রা বলবতী হলো না। সংবাদ পেয়ে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি মোজ্জফওরপুরএ এক ধর্মশালায় এসে উঠলেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ করা। তারা লক্ষ করলেন কিংসফোর্ড প্রতিদিন রাট ৮টা এ একটা ফিটন গাড়িতে ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরলেন ।সেদিন ছিল নিঝুম রাত । ১৯০৮ সালের ৩০এ এপ্রিল। একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি কিংসফোর্ডের গাড়ি আসার প্রতীক্ষা করছিলেন। .।একটু পরেই গাড়ি আসার শব্দ পাওয়া গেলো। বিপ্লবীরা বোমা ছুড়লেন। আগুন ধরে গেলো ওই ফিতনা গাড়িতে। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল দুজনেই খুব খুশি বাড়ি ফিরছিলেন । কিন্তু তাদের হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। যে গাড়ি লক্ষ্য করে তারা বোমা ছুড়ছিলেন সে গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন ব্যারিস্টার কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও মেয়ে। আঘাত পেয়ে তারা মারা গেলেন। এই সংবাদ শহরের সর্বত্র দাবালনের মতো ছড়িয়ে পড়লো। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়লেন। তবে ধরা পড়ার আগেই প্রফুল্ল আত্মহত্যা করলেন। আর ক্ষুদিরাম তা না পেয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি
১৯০৮সালের ১১ই অগাস্ট। ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন ধার্য হলো। এই সুন্দর পৃথিবী ত্যাগ করে তাকে চলে যেতে হবে। এই ভেবে খুব ভোরে ক্ষুদিরাম উঠে পড়লেন। তৈরি হলেন ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার জন্য। ,মনে মনে গাইছিলেন একটি গান। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ; ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি ছিলেন নির্ভিক। হাঁসি মুখে দড়ি গলায় দিয়ে তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন। হাঁসতে হাঁসতে পরান দিলো অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম। তার এই আত্মত্যাগ দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশকে ভালোবাসার একটা অনুপ্রেরণা ,একটা আদর্শ .।
উপসংহার
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ক্ষুদিরামের জীবনের উৎসর্গ এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহের মা.বোন ,যুবক যুবতী তরুণ তরুণী প্রতিটি ছাত্র ও শিক্ষকের কাছে এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের আত্মবলিদানের ইতিহাসের গাঁথা জেগে থাকবে চিরকাল ,.।
Also See: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী