ভূমিকা :- বাংলা ভাষাকে নিপুণ ভাবে শিখতে হলে বাংলা ব্যাকরণ জানা অত্যন্ত জরুরি । ব্যাকরণ হল ভাষার সার্বিক প্রকাশ । ভাষাকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করতে ব্যাকরন প্রয়োগ করা হয় । বর্তমানে ভাষা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ভাষাবিজ্ঞান রয়েছে । আমরা এখন প্রচলিত ব্যাকরণ সম্পর্কে জানবো ।
বাংলা ব্যাকরণ আর ইংরেজি গ্রামার এর মধ্যে তফাৎ : – আমরা প্রত্যেকেই মনে করি যে বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি গ্রামার একই বিষয় । কিন্তু এই ভাবনা একদমই ভুল । পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “সংস্কৃত বা বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার এক জিনিস নয় । Grammar is the art of speaking and writing a language correctly. ব্যাকরণ ব্যবহার হয় বাক্য কে শুদ্ধ করার জন্য । তাই বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি গ্রামার এক নয়।” ব্যাকরণ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই, বি + আ + কৃ + অন, যার অর্থ হল, বিশেষরূপে এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ করা । ভাষাকে সম্পূর্ণরূপ দিতে ব্যাকরণ ব্যবহার করা আবশ্যক । এক কথায় ব্যাকরণ হল ভাষার সংবিধান।
বাংলা ব্যাকরণের ঐতিহাসিক কথা :- বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে জানার আগে বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক –
আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে ব্যাকরণ শব্দটি উদ্ভাবন ঘটে । প্রথম যিনি বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন তিনি বাঙালী কিংবা ভারতীয় নন । প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন পর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল-দ্য-অসুম্পসাও ১৭৩৪ সালে । তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম – “Vocabulario Em Idoma portuguez E Dividido Em duas Partes” । এরপর ইংরেজি পন্ডিত হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায় ‘বাংলা ব্যাকরণ’ রচনা করেন । রাজা রামমোহন রায়ও ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন ১৭৭৮ সালে । তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম ‘দ্য গ্রামার ওফ দ্য বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ’, ১৮৩৩ সালে সেটি বাংলায় আনুবাদ করে নাম দেওয়া হয় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’। ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাকরণবিদের নাম পাণিনি । তিনি সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণবিদ । পরবর্তীকালে অনেকেই বাংলা ব্যাকরণ রচনায় সাফল্য লাভ করেন ।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা :- কোনো ভাষাকে ভালো ভাবে জানতে হলে ব্যাকরণ অবশই পড়তে হবে । ব্যাকরণ ভাষাকে সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে সাহায্য করে । ব্যাকরণ উপর নির্ভর করে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে ও ভাষার বদল হয় । ভাষাকে বিশেষ ভাবে বিশ্লেষন ও নিয়ন্ত্রণ করতে ভাষার উপর নির্ভর করতে হয় । ব্যাকরণ এর সাহায্যে ভাষার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগ রীতি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায় । ভাষার মূল সম্পদ হল শব্দভান্ডার, আর ব্যাকরণ পড়লে শব্দের উৎস ও বিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারি । শব্দ সুন্দর ও শৃঙ্খল ভাবে বাক্য গঠনে সাহায্য করে । বাক্যের গঠন, প্রকার ভেদ ও পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে আলোচনা করে ব্যাকরণ । বাংলা ভাষাকে সুন্দর, শুদ্ধ ভাবে বুঝতে, লিখতে ও বলার পারার জন্য ব্যাকরণ পড়া অত্যন্ত জরুরি । এক কথায় বলতে গেলে, কীভাবে শব্দ তৈরি করব, শব্দকে জুড়ে কীভাবে পধবন্ধে রূপে দেব, আবার পদবন্ধ জুরে কিভাবে বাক্য তৈরি করব তা পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যাকরণের উপর ।
বাংলা ব্যাকরণের অসুবিধে :- বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষার পথে প্রধান বাধা হল যথার্থ ব্যাকরণ বই এর সরাবরাহ না থাকা । বেশিরভাগ বাংলা ব্যাকরণ বই গুলো সংস্কৃত পন্ডিতদের দ্বারাই রচিত হয়েছিল । এর জন্য বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃত-এর প্রভাব লক্ষ করা যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আমরা যেমন বিদ্যালয়ে ভারতের নাম দিয়ে মহম্মদ ঘোরী, বাবর, হুমায়ূনের ইতিহাস পড়ি, তাতে অতি অল্প পরিমান ভারতবর্ষ মিশ্রিত থাকে, তেমনি আমরা বাংলা ব্যাকরণ নাম দিয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ে থাকি, তাতে অতি অল্প পরিমানে বাংলার গন্ধ পাওয়া যায় ।”
বর্তমানে স্কুলের পাঠ্য ব্যাকরণ বই গুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা লক্ষ করা যায় । এতে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর মনে এক বিভ্রান্তি তৈরি হয় । যেমন কিছু বই এ সমাস ছয় প্রকার আবার কিছু বই এ অব্যয়ীভাব সমাসকে যোগ করে সাত প্রকার দেখানো হয়েছে । এতে ছাত্র-ছাত্রীর মনে কৌতূহল তৈরি হয় ।
যেমন বাংলা ব্যাকরণে-এ প্রত্যয় নির্ণয় করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক নব ছাত্র ছার্ত্রীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । কারণ বাংলা ব্যাকরণে প্রত্যয় এর নিয়ম সংস্কৃত ব্যাকরণ এর নিয়ম দ্বারা প্রভাবিত । যেমন “গম + ক্কিপ” শব্দ দুটি মিলিত হয়ে তৈরি হয় “জগৎ” । এই নিয়ম বুঝতে অনেক নতুন ছাত্র-ছাত্রীর অসুবিধের সম্মুখিন হতে হয় । বিশেষ করে বাংলা ব্যাকরণ বিষয়টি দশম শ্রেণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকায় পরবর্তি কালে ডিগ্রি কোর্স এর পর ব্যাকরণ সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলে । কেউ যদি শিক্ষাকতার পেশায় আসতে চায় তাঁকে নতুন করে বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হয় ।